বিপরীতের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আমরা | হুমায়ুন রশিদ

প্রকাশিত: ১:৫২ অপরাহ্ণ, জুলাই ১২, ২০২৫

রাষ্ট্র পরিচালনার একটি স্বাভাবিক নিয়ম আছে। প্রত্যেকে নিজের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করবে, সেই দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়েই গঠিত হবে একটি উন্নত ও মানবিক রাষ্ট্র। কিন্তু বাস্তবতা বড়ই বিস্ময়কর। আমাদের বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থা যেন ঠিক উল্টো পথে হাঁটছে। যে যেখানে থাকার কথা, সে সেখানে নেই; যার যা কাজ, সে ঠিক তার উল্টোটাই করছে। চারপাশে তাকালেই এমন সব উদাহরণ চোখে পড়ে, যা দেখে মনে হয় — আমরা যেন এক “বিপরীত রাষ্ট্র ব্যবস্থা”এর বাসিন্দা।এই বিপরীত রাষ্ট্র ব্যবস্থার বাস্তবিক কিছু চিত্র( লেখকের নিজস্ব অভিমত) পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো

সাংবাদিকদের প্রধান কাজ সত্য উদ্ঘাটন ও প্রশ্ন করা। কিন্তু আজকাল বেশিরভাগ সাংবাদিক শুধু প্রশংসা করতেই ব্যস্ত। তারা প্রশ্ন তোলেন না, বরং যারা প্রশ্ন তোলে তাদের মুখ বন্ধ করতে ভূমিকা রাখেন। পক্ষপাতদুষ্ট সংবাদ পরিবেশন বর্তমানে গর্বের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।বেশিরভাগ সাংবাদিককেই দেখা যায় ক্ষমতাবানদের প্রশংসায় ব্যস্ত, যেন তারা বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্র।

রাজনীতিবিদের কাজ হওয়া উচিত জনগণের সমস্যার সমাধান করা, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। অথচ বাস্তবে দেখা যায়, তারাই নতুন সমস্যা তৈরি করেন, বিভাজন সৃষ্টি করেন, ক্ষমতার রাজনীতি করেন। রাজনীতি হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার বিপরীতমুখী এক খেলা।

ছাত্র-ছাত্রীদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব পড়ালেখা করা, নিজেকে গড়ে তোলা। কিন্তু এখন অনেক শিক্ষার্থী রাজনীতিতেই বেশি জড়িত।পড়ালেখার চাইতে প্রতিষ্ঠানে দলীয় প্রভাব বিস্তারই যেন বড় অর্জন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক প্রভাবের আঁতুড়ঘর।
শিক্ষকদের কাজ শিক্ষার্থীদের জ্ঞান দেওয়া, শ্রেণিকক্ষে মনোযোগ দিয়ে পাঠদান করা। কিন্তু বেশিরভাগ শিক্ষক এখন কোচিং সেন্টারেই বেশি আগ্রহী। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দায়সারা পাঠদান করে তারা প্রাইভেট বা কোচিংয়ে সময় দেন, যেখানে শিক্ষার্থীরা আবার টাকা দিয়ে পড়তে আসে।

ডাক্তারদের দায়িত্ব হলো হাসপাতালে রোগীদের সেবা দেওয়া। কিন্তু দেখা যায়, সরকারি হাসপাতালের ডাক্তাররা নিয়মিত অনুপস্থিত। অথচ সন্ধ্যায় তাদের চেম্বারে গেলে দেখা মেলে। চিকিৎসা যেন সেবার বদলে ব্যবসায় পরিণত হয়েছে।
জনগনের বন্ধু পুলিশের কাজ অপরাধ দমন করা। কিন্তু বাস্তবে অনেক পুলিশই হয়ে উঠেছেন ঘুষের বিনিময়ে অপরাধীদের রক্ষক। নিরীহ জনগণ বরং পুলিশের উপস্থিতি দেখেই ভয় পান।
বিচারকের দায়িত্ব নিরপেক্ষ বিচার। কিন্তু কিছু বিচারক রাজনৈতিক প্রভাব, অর্থ বা তদবিরের কাছে নতিস্বীকার করেন। ফলে ন্যায়বিচার হয়ে পড়ে বিলাসিতা।
ইমাম বা ধর্মীয় নেতার দায়িত্ব মানুষকে শান্তির পথে ডাকা, বিনয়ী হওয়া শেখানো। কিন্তু আজ কিছু ধর্মগুরু ধর্মকে ব্যবহার করেন রাজনীতি বা বিদ্বেষ ছড়াতে।
ব্যবসায়ীর কাজ সঠিক পণ্য, সঠিক মূল্যে দেওয়া। কিন্তু অনেকেই মুনাফার লোভে ভেজাল দেন, দাম বাড়ান, প্রতারণা করেন। সেবা নয়, মুনাফাই তাদের প্রধান লক্ষ্য।
প্রশাসনের কাজ জনগণকে সেবা দেওয়া। অথচ একটা কাজ করাতে হলে ঘুষ, তদবির, অপেক্ষা — সব কিছু পেরিয়ে যেতে হয়। বেশিরভাগ সরকারি কর্মকর্তা সময়মতো অফিসেই আসেন না।
এইসব বিপরীত চর্চা আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ক্রমাগত দুর্বল করে তুলছে। সমাজের প্রতিটি স্তরে যখন দায়িত্ব ও বাস্তবতার এই ধরনের ফারাক তৈরি হয়, তখন একটি জাতি তার মূল লক্ষ্যের পথ হারিয়ে ফেলে।
আমাদের দরকার আত্মসমালোচনা, দায়বদ্ধতা এবং ইতিবাচক পরিবর্তনের সাহস। প্রত্যেককে তার নিজ দায়িত্বে ফিরে যেতে হবে। না হলে এই “বিপরীতের রাষ্ট্র ব্যবস্থা” আমাদের ভবিষ্যৎকে করে তুলবে আরও অনিশ্চিত ও অন্ধকার।

লেখা – হুমায়ুন রশিদ
আহ্বায়ক, বাঘাইছড়ি উপজেলা ছাত্রদল